উজিরে আজম থেকে কোণঠাসা বাঘ

 

তারিক চয়ন •

১৯৯২ সালের ২৫শে মার্চ। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালে মুখোমুখি ইংল্যান্ড এবং পাকিস্তান। তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা ইংল্যান্ড এবার ট্রফির জন্য মরণ কামড় দিচ্ছে। ইমরান খান ক্যাপ্টেন্স নক ৭২ রান করে দলকে ২৪৯ রানের সংগ্রহ করতে বড় ভূমিকা রাখলেন। জবাবে ব্যাট করতে নেমে শুরুর দিকে বৃটিশরা পাকিস্তানের কাছ থেকে জয় ছিনিয়ে নিতে শুরু করলেও ইমরানের দারুণ ক্যাপ্টেন্সির কাছে তারা ব্যর্থ হয়।

২০২২ সালের ২৫শে মার্চ। ঠিক ৩০ বছর পর। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর আনা অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে জাতীয় পরিষদে। অনাস্থা ভোটে হেরে গেলে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রিত্ব হারাবেন। কিন্তু না। ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব না তুলেই সেদিন অধিবেশন মুলতবি করা হয়

জাতীয় পরিষদের এক সদস্যের মৃত্যুর কারণ দেখিয়ে ২৮শে মার্চ বিকাল ৪টা পর্যন্ত অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করেন স্পিকার। এ যাত্রা বেঁচে গেলেন ইমরান।

সুতরাং, ২৫শে মার্চ তারিখটিকে ইমরানের জন্য ‘লাকি ডে’ বলা চলে। কিন্তু, জীবনের সব তারিখই ভাগ্য কারো জন্যই সুপ্রসন্ন হয় না। ইমরানের ক্ষেত্রেও নয়। ৩০ বছর আগে পশ্চিমা পরাশক্তি যুক্তরাজ্যকে ক্রিকেটের মাঠে হারিয়ে দিয়েছিলেন ইমরান। ৩০ বছর পর আরেক পশ্চিমা পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের ‘ষড়যন্ত্র’ ফাঁস করে দিয়েও রাজনীতির মাঠে হেরে গেছেন তিনি। নানা নাটকীয়তার পর পাকিস্তানের ইতিহাসে অনাস্থা ভোটে হেরে যাওয়া প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নাম লিখিয়েছেন দেশটিকে প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফি এনে দেয়া ইমরান খান। আর এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের প্রথম ‘উজিরে আজম’ তথা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করার রেকর্ড গড়তেও ব্যর্থ হলেন ইমরান।

ছোটবেলায় শান্ত আর লাজুক ছিলেন ইমরান

১৯৫২ সালে লাহোরে জন্ম হয়েছিল ইমরানের। তার বাবা ইকরামুল্লাহ খান নিয়াজী ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। মা শওকত খানম ছিলেন গৃহিণী। তাদের সংসারে চার কন্যা থাকলেও একমাত্র পুত্র ইমরান। বাবা-মা দু’জনই পশতুন বংশোদ্ভূত। বাবার দিক থেকে ইমরান ষোড়শ শতকের সুলতান শের শাহ সুরির অন্যতম সেনাপতি এবং পাঞ্জাবের তৎকালীন গভর্নর হাইবত খান নিয়াজীর বংশধর। আর মায়ের দিক থেকে তিনি সুফি, যোদ্ধা, কবি, পশতু বর্ণমালার উদ্ভাবক পীর রোশানের বংশধর। বোনদের সঙ্গে বেড়ে উঠা ইমরান ছোটবেলায় শান্ত এবং লাজুক স্বভাবের ছিলেন। পরবর্তীতে ক্রিকেটার হিসেবে দেয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেও তার এমন স্বভাবের কথা বলেছিলেন। অনেকেই জানেন, ইমরান খান বিশ্বখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু সেখানে পড়ার আগেও উচ্চ মধ্যবিত্ত, সম্ভ্রান্ত, শিক্ষিত পরিবারে জন্ম নেয়া ইমরান বেশ ভালো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই পড়ালেখা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি লাহোরের আইচিসন কলেজ, ক্যাথেড্রাল স্কুল এবং পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের রয়্যাল গ্রামার স্কুল ওরচেস্টারে পড়াশোনা করেছেন। ওই ওরচেস্টারেই তার ক্রিকেটে হাতেখড়ি হয়। ১৯৭২ সালে তিনি অক্সফোর্ডের কেবল কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৭৫ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন।

বোনেরা বোলিং করতেন, ব্যাটিং করতেন ইমরান
ইমরানের মায়ের বংশ থেকে বিশ্বসেরা অনেক ক্রিকেটার উঠে এসেছেন। ইমরানের খালাতো মামাতো ভাইদের মধ্যে জাভেদ বুরকি, মাজিদ খানের মতো ক্রিকেটাররা তো পাকিস্তান জাতীয় দলেও খেলেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনরা একত্র হলেই ক্রিকেট নিয়ে গল্প হতো। মাঠে প্র্যাকটিস করার পর ইমরান ঘরে ফিরেও প্র্যাকটিস করতেন। তাদের বাড়িতে একটি ছোট্ট ইনডোর মাঠ ছিল যেখানে বোনদের নিয়ে গিয়ে তিনি তাদের দিয়ে বল করাতেন আর নিজে একমনে ব্যাটিং করতেন। বোনেরা বল করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলেও ইমরান তার ব্যাটিং চালিয়েই যেতেন।

৭১-এর ২৫শে মার্চের ঠিক আগেই ঢাকায় ছিলেন ইমরান!
২০১১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ইমরান খানের রাজনৈতিক আত্মজীবনী ‘পাকিস্তান: এ পার্সোনাল হিস্ট্রি’। বইটিতে বাংলাদেশ বিষয়ে ইমরান দিয়েছেন এক চমকপ্রদ তথ্য। সময়টা ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। ইমরানের বয়স তখন প্রায় ১৯ বছর। ইতিমধ্যেই স্কুল কলেজে ভালো খেলে নির্বাচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাকিস্তান অনূর্ধ্ব-১৯ দলের খেলোয়াড় হিসেবে জায়গা পেয়ে যান। ওই দলের হয়ে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান দলের বিপক্ষে খেলতে। ইমরান তার বইয়ে জানিয়েছেন, ঢাকা স্টেডিয়ামের দর্শক, প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড় থেকে শুরু করে সবকিছুই সেদিন তাদের কাছে শত্রুভাবাপন্ন মনে হচ্ছিল। অনেকেই বলেন, পাকিস্তানি আক্রমণ শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া শেষ ফ্লাইটেই ছিলেন ইমরান খান। এছাড়াও, ১৯৮৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ভারতের বিপক্ষে একটি প্রীতি ম্যাচে পাকিস্তান দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জানিয়ে ইমরান এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেন, ওই ম্যাচ জয়ের পর দর্শকদের উল্লাস দেখে মনে হচ্ছিল যেনো আমি লাহোরে (নিজের জন্মস্থান) জিতে গেছি। এটা ভেবে আমার কান্না আসছিল যে, আমাদের জন্য তাদের কী পরিমাণ ভালোবাসা। পাঁচ মাইল পথ মানুষ ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলতে বলতে অভিনন্দন জানিয়েছে। আমার কষ্ট হয় এটা ভেবে যে, আমরা তাদের সঙ্গে কী কাজটাই না করেছি।

ইমরানের ‘পিপিই’র শিক্ষার্থী নামকরা সব বিশ্বনেতারা!
একশ’ বছরেরও আগে থেকে বৃটেনের বিশ্বখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন, রাজনীতি এবং অর্থনীতি (পিপিই) নামে একটি বিষয় পড়ানো হচ্ছে। প্রভাবশালী বৃটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান কয়েক বছর আগে ‘বৃটেনকে চালায় যে পিপিই ডিগ্রি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বৃটেনের অসংখ্য প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী এমপির বাইরেও বিল ক্লিনটন, বেনজির ভুট্টো, অং সান সু চি, ম্যালকম ফ্রেজারের মতো নেতারা পিপিই’র শিক্ষার্থী ছিলেন। গার্ডিয়ানের ওই প্রতিবেদনটি ২০১৭ সালে তৈরি। আর এক বছর পর প্রকাশিত হলে ওই প্রতিবেদনে একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খানের নামও লেখা থাকতো, কেননা ইমরানও যে ওই পিপিই’র শিক্ষার্থী ছিলেন।

‘প্রতি সন্ধ্যায় আমি নাইটক্লাবে যাই না’
৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতা, ফর্সা, সুদর্শন; সঙ্গে ওয়েস্টার্ন লুক। ইমরান খান জীবনে অগণিত নারীর সঙ্গে প্রেম করেছেন বলে জোর গুজব রয়েছে। তাদের মধ্যে হলিউডের অস্কারজয়ী অভিনেত্রী গোল্ডি হন যেমন রয়েছেন, তেমনি এক সময়ে বলিউডের পর্দা কাঁপানো আবেদনময়ী অভিনেত্রী জিনাত আমানও রয়েছেন। শোনা যায়, জনপ্রিয় বলিউড অভিনেত্রী রেখার সঙ্গে ইমরানের প্রেমের সম্পর্ক প্রায় বিয়ে পর্যন্ত গড়িয়েছিল। এছাড়া, শক্তিশালী বলিউড অভিনেত্রী শাবানা আজমি, মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের কন্যা অভিনেত্রী মুনমুন সেনের সঙ্গে ইমরানের প্রেম ছিল বলে গুজব রয়েছে। বিভিন্ন অঙ্গনের অসংখ্য বৃটিশ তারকার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে ইমরানের নাম জড়িয়েছে। এমনকি বৃটিশ সাংবাদিক ক্রিস্টোফার স্যানফোর্ড তার বই ‘ইমরান খান: দ্য ক্রিকেটার দ্য সেলিব্রিটি দ্য পলিটিশিয়ান’ বইতে দাবি করেছেন, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর সঙ্গে ইমরানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল যখন তারা উভয়ই অক্সফোর্ডের শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৯৭৫ সালে বেনজির ২১ বছর বয়সে ইমরানের সঙ্গে প্রথম ঘনিষ্ঠ হন। তাদের সম্পর্ক প্রায় দুই মাস ছিল। ইমরানের মা তাদের বিয়ে দেয়ার জন্য চেষ্টা করলেও ইমরান তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, তারা শুধুই বন্ধু। ইমরান খানের ‘প্লেবয় ইমেজ’ নিয়ে তাকে ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই নানা সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। রাজনীতিতে নামার পরও ওই ইমেজ তার পিছু ছাড়ে নি। ১৯৮৩ সালে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি নিজেকে একজন ক্রিকেটারই ভেবে এসেছি। কোন প্লেবয় নয়। প্রতি সন্ধ্যায় আমি নাইটক্লাবে যাই না। আমি সিগারেট খাই না, মদ্যপানও করি না। আমি নিজেকে একজন পরিশ্রমী ক্রিকেটার মনে করি।’

বলিউড মুভিতে অভিনয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান
শুধু অভিনেত্রীদের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেমই করেননি ইমরান খান। নিজেও পেয়েছিলেন অভিনয়ের প্রস্তাব। তাও যে সে কিছু নয়। ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মভূষণ’, ‘দাদা সাহেব ফালকে’ পুরস্কার প্রাপ্ত ‘চিরসবুজ রোমান্টিক তারকা’ খ্যাত প্রয়াত জনপ্রিয় অভিনেতা-পরিচালক দেব আনন্দ একবার তাকে বলিউডের মুভিতে অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ইমরানকে রাজি করাতে দেব সুদূর ইংল্যান্ড পর্যন্ত গিয়েছিলেন। কিন্তু, অভিনয় দক্ষতা না থাকার কথা বলে ইমরান ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দেন। ইমরান খান নিজেই এ ঘটনার কথা স্বীকার করেছেন। দেব আনন্দ তার আত্মজীবনী ‘রোমান্সিং ওইথ লাইফ’তে ওই ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়া, ভারতীয় বংশোদ্ভূত পরিচালক ইসমাইল মার্চেন্টও ইমরানকে মুভিতে অভিনয়ের জন্য বলেছিলেন। ওই প্রস্তাবও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ইমরানের বক্তব্য ছিল, ‘এটা অদ্ভুত। ক্রিকেটার হয়েছি বলে আমি অভিনয়ও করতে পারবো তাতো নয়। এটা আমার বুঝে আসে না। আমিতো অভিনয় করতে পারি না। আমি মুভিতো দূর, স্কুলের কোন নাটকেও অভিনয়ের যোগ্য নই।’

বিজ্ঞাপনে ইমরান
মুভিতে অভিনয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও ইমরান খান সেলিব্রিটি ব্র্যান্ড এন্ডোর্সার হিসেবে বহু টিভিসিতে অভিনয় করেছেন। এসবের মধ্যে রয়েছে কোমল পানীয় পেপসি, বিবি টিপস্ চা। ইমরান ভারতীয় সাবানের ব্র্যান্ড সিন্থোলের বিজ্ঞাপন এমন এক সময়ে করেছিলেন, যখন একই কাজ করছিলেন বলিউড স্টার বিনোদ খান্না। এছাড়া দাতব্য কাজে তিনি ভারতীয় ক্রিকেট কিংবদন্তি ‘লিটল মাস্টার’ খ্যাত সুনীল গাভাস্কারের সঙ্গে কোকাকোলার বিজ্ঞাপনেও অংশ নিয়েছিলেন। দু’জন একসঙ্গে জনপ্রিয় ব্র?্যান্ড ‘থামস আপ’ কেও এন্ডোর্স করেছেন।

ভারতীয় ক্রিকেটার ও বলিউড তারকাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব
ক্রিকেটের মাঠে চিরশত্রু হলেও বাস্তবজীবনে ভারতের অনেক ক্রিকেটারের সঙ্গে ইমরানের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব রয়েছে এবং সেটা খেলোয়াড়ি জীবন থেকেই। ভারতীয় ব্যাটিং লিজেন্ড সুনীল গাভাস্কারের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব বেশ পুরনো। বিভিন্ন সময় দুজন দু’জনকে প্রশংসাও করেছেন। সুনীল মজা করে বলতেন, ইমরানের সামনে পড়লে দোয়া করতাম যেন ওর প্রথম বলটা ফুলটস হয়, যেন অন্তত একটা রান নিতে পারি। ইমরানও সুনীলের বিদায়ী টেস্ট ম্যাচে করা ৯৬ রানের ইনিংসকে নিজের দেখা সেরা বলে অভিহিত করতেন। মা’র নামে করা ক্যান্সার হাসপাতালের জন্য কোকাকোলার বিজ্ঞাপনেও ইমরানের সঙ্গে সুনীল অভিনয় করেছিলেন। দাতব্য কাজে আয়োজিত প্রীতি ম্যাচ খেলতে পাকিস্তানেও গিয়েছিলেন সুনীল। ইমরান প্রধানমন্ত্রী হলে নিজের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সুনীল গাভাস্কার ছাড়াও বিশ্বখ্যাত অলরাউন্ডার কপিল দেব, ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া পাঞ্জাবের সাবেক মন্ত্রী নভজ্যোত সিং সিধু, বলিউড সুপারস্টার আমির খানকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এছাড়া, ইমরানের গড়া ক্যান্সার হাসপাতালের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে ১৯৯২ সালে লন্ডনে আয়োজিত কনসার্টে বৃটিশ রক অ্যান্ড রোল ব্যান্ড ‘রোলিং স্টোনস’ এর ‘লিড ভোকাল’ মিক জ্যাগার, সুফি সম্রাট খ্যাত নুসরাত ফতেহ আলী খানদের মতো তারকাদের সঙ্গে হাজির হয়েছিলেন স্বয়ং বলিউড বাদশাহ অমিতাভ বচ্চন। অমিতাভ ওই অনুষ্ঠানে ইমরানের যেকোনো উদ্যোগে পাশে থাকবার প্রতিশ্রুতি দেন।

৯২ বিশ্বকাপ জেতা দূর, খেলারই কথা ছিল না ইমরানের!
১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পর ইমরান খান আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। ওই সময় পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউল হক। তিনি ইমরানকে ফের দলের নেতৃত্বে ফিরে আসতে বলেছিলেন। ইমরান জিয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন। ইমরান তখন অবসর থেকে না ফিরলে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ জয় তো দূর, ওই টুর্নামেন্টে তার খেলাই হতো না।

কখনো আউট হতে বা হারতে চাইতেন না ইমরান
ইমরান খানের অধীনে খেলা কেমন ছিল তা বলতে গিয়ে পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার মুদাসসর নজর ইএসপিএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ইমরান যখন অধিনায়ক হলেন তখন (দলের) কেউ বুঝে উঠতে পারেনি কী হতে যাচ্ছে। বোলিং করার সময় তিনি মেজাজী ছিলেন। কেউ মিসফিল্ডিং করলে তার মেজাজ খারাপ হতো। তিনি কখনো হারতে চাইতেন না। কিন্তু (ক্যাপ্টেন হওয়ার পর) তিনি দ্রুতই নিজেকে মানিয়ে নেন।’ ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে আউট হওয়া বা হেরে যাওয়াকে যেন কিছুতেই সহজে মানতে পারতেন না ইমরান তা নিজের আত্মজীবনীতে অকপটে স্বীকার করে লিখেছেন, ‘আমার বল প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের চেয়ে ফিল্ডারদেরই ভয়ের কারণ হতো। আমার ফিল্ডিং ছিল যেকোনো সহখেলোয়াড়ের বিরক্তির কারণ। ব্যাট করতে নেমে কয়েকটা বল কোনোরকমে খেলতাম, তারপর আউট হওয়া মাত্রই রেগেমেগে ব্যাট ছুড়ে দিয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে যেতাম। অনেক যুক্তি দিয়ে নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করতাম যে, এটা আসলে নো বল ছিল। অর্থাৎ আমি আউট হইনি। কিন্তু, কিছুতেই আউট হওয়াটাকে সহজে মানতে পারতাম না।’ বছর দশেক আগে পাকিস্তানের এক টিভি চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ইমরান বলেছিলেন, ‘কিছুতেই আমি মন খারাপ করি না। কেননা, আমি সংকটকে সব সময় সুযোগ ভেবে এসেছি।’

ক্যাপ্টেন অনেক ছিলেন, কিন্তু লিডার একজনই
নিজের সময়ে, ইমরান খান ছিলেন বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন। তিনি ছিলেন বিশ্বমানের ফাস্ট বোলার। কিন্তু নেতৃত্ব গুণই তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তুলেছিল। আশির দশকে পাকিস্তান দলের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ম্যাচ খেলেছিলেন ভারতীয় স্পিনার মানিন্দর সিং। তিনি বার্তা সংস্থা পিটিআইকে ইমরান সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ইমরান ওদের (পাকিস্তান দলের) অধিনায়ক, কোচ, প্রধান নির্বাচক সবকিছুই ছিল। অধিনায়ক থাকাকালীন সময়ে এস্টাবিলিশমেন্ট তার সঙ্গে লাগতে যেত বলে আমার মনে হয় না। ওর চোখ সব সময় প্রতিভা খুঁজে বেড়াতো। খুব দৃঢ়প্রত্যয়ী ছিল ইমরান।’ বলা হয়ে থাকে, বোলার হিসেবে ওয়াসিম আকরাম ইমরানের চেয়ে বেশি শৈল্পিক ছিলেন কিন্তু ‘ক্যাপ্টেন ইমরান’ তাকে গাইড করার জন্য মিড-অনে না দাঁড়ালে ওয়াসিমকে বিশ্ব যেভাবে চিনেছে তার অর্ধেকও তিনি হতে পারতেন না। ওয়াসিম রিভার্স সুইং-এর রাজা হয়ে ওঠেন। তৎকালীন ‘ডার্ক আর্ট’ বলে বিবেচিত রিভার্স সুইংয়ের পাঠও ওয়াসিম পেয়েছিলেন ক্যাপ্টেনের কাছ থেকেই। টেলিভিশিনে দেশের স্থানীয় পর্যায়ের একটি ম্যাচে ওয়াকার ইউনিসের খেলা এক পলক দেখেই ইমরান তার সুপ্ত প্রতিভা আবিষ্কার করে ফেলেন এবং পিসিবি কর্মকর্তাদের বলেন তার খোঁজ লাগাতে। বাকিটা তো ইতিহাস। বিশ্বকাপ বিজয়ের পথেই তিনি আরেক প্রতিভা তরুণ ইনজামাম-উল-হককে আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে ইমরানের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব বলা হয় জাভেদ মিয়াঁদাদকে সামলানোর ব্যাপারটা। জাভেদ ছিলেন দলের সেরা ব্যাটসম্যান এবং ইমরানের মতোই আগ্রাসী। ইমরানের নেতৃত্বের দক্ষতা নিয়ে আলোচনা করার সময় বলেন, তিনি যে কত বড় মাপের ক্রিকেটার ছিলেন সেটা- এমনকি তার শত্রুও উপেক্ষা করতে পারবে না। বলা হয়ে থাকে, ইমরানের সময়টায় সারা দুনিয়ায় ক্যাপ্টেন অনেকেই ছিলেন, কিন্তু লিডার একজনই।

ফাইটার জেট, কাপ্তান, তালেবান খান
পাকিস্তানে ইমরান খানকে ‘কাপ্তান’ নামেই বেশি ডাকেন তার ভক্ত-সমর্থকরা। উর্দুতে কাপ্তান শব্দের মানে হলো ক্যাপ্টেন বা অধিনায়ক। ইমরানকে কেন কাপ্তান ডাকা হয় তা বলাবাহুল্য। ১৯৮২-৮৩ সালে ভারতের বিরুদ্ধে ৩-০তে সিরিজ জয়ে ইমরান নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ৪০টির মতো উইকেটও নিয়েছিলেন। কাকতালীয়ভাবে ওই সময়েই যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে বিখ্যাত এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান দিয়েছিল। পাকিস্তানের ক্রিকেট ভক্তরা ইমরানকে তখন ফাইটার-জেট নামে ডাকতে শুরু করে। বরাবরই নিজ দেশের পলিটিক্যাল এস্টাবিলিশমেন্টের সঙ্গে বিবাদে জড়ানো ইমরানকে পরবর্তীকালে তার রাজনৈতিক বিরোধীরা ব্যঙ্গ করে ‘তালেবান খান’ নাম দেন। জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করার কারণে ইমরানকে ‘ইহুদি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন পাকিস্তানের মুসলিম ধর্মগুরু মাওলানা ফজলুর রহমানের মতো নেতা।

মায়ের মৃত্যু, ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা
বিশ্বকাপ জয়ের পর চূড়ান্তভাবে ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণ করেন ইমরান। এর অনেক আগেই, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮৫ সালে মারা যান ইমরানের মা শওকত খানম। তখন থেকেই তার মাথায় ছিল মায়ের নামে একটি ক্যান্সার হাসপাতাল তৈরি করা এবং পাকিস্তানের দরিদ্রদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া। ১৯৯১ সালে ইমরান মা’র নামে শওকত খানম মেমোরিয়াল ট্রাস্ট নামে একটি দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ট্রাস্টের প্রথম উদ্যোগ হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পাকিস্তানের প্রথম এবং একমাত্র ক্যান্সার হাসপাতাল ‘শওকত খানম মেমোরিয়াল ক্যান্সার হসপিটাল। পাকিস্তান সরকার তার ওই মহৎ উদ্দেশ্যে এগিয়ে এসে তাকে লাহোরের উপকণ্ঠে ২০ একর জমি দান করেছিল। এক দশকব্যাপী অক্লান্তভাবে তহবিল সংগ্রহ এবং কঠোর পরিশ্রমের পর, ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে বিশ্বমানের হাসপাতালটি উদ্বোধন করা হয়। এটি ছিল লাহোরের প্রথম এবং এখনও পর্যন্ত একমাত্র ক্যান্সার হাসপাতাল। এটি নির্মিত হয়েছিল সারা বিশ্ব থেকে আড়াই কোটি ডলারেরও বেশি তহবিল সংগ্রহের মাধ্যমে। হাসপাতালের জন্য তহবিল সংগ্রহে ইমরান পাশে পেয়েছিলেন সারা বিশ্বের বিভিন্ন জগতের নামিদামি সব তারকাকে। রোলিং স্টোনস তারকা মিক জ্যাগার, সুফি সম্রাট নুসরাত ফতেহ আলী খান ছাড়াও ভারতের দিলীপ কুমার, অমিতাভ বচ্চন, সুনীল গাভাস্কারসহ অনেকেই ছিলেন তার পাশে। হাসপাতালের সহায়তা তহবিল সংগ্রহে ইমরান ও তার প্রথম স্ত্রী জেমিমার বন্ধু প্রয়াত বৃটিশ রাজবধূ প্রিন্সেস ডায়ানা একাধিকবার পাকিস্তান সফর করেছিলেন। লাহোরের হাসপাতালটির শয্যাসংখ্যা এখন ৬০০। একইভাবে পেশোয়ারেও নির্মাণ করা হয়েছে আরেকটি ক্যান্সার হাসপাতাল। করাচিতেও আরেকটির কাজ চলছে। এসব হাসপাতালে প্রায় চার ভাগের তিনভাগ চিকিৎসাই হয় অসহায় দরিদ্রদের যা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে।

‘বিয়ে করাতো কোনো অপরাধ নয়’
ইমরান খান উপমহাদেশের অন্যান্য ছেলেদের চাইতে তুলনামূলকভাবে দেরিতে বিয়ে করেছেন। ৪২ বছর বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত ইমরান পরের ২৩ বছরে তিনটি বিয়ে করেছেন। বৃটিশ ধনকুবের জেমস গোল্ডস্মিথের মেয়ে জেমিমা গোল্ডস্মিথকে ১৯৯৫ সালে প্রেমের শহর প্যারিসে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন ৪২ বছর বয়সী ইমরান।
ইমরানের চেয়ে প্রায় অর্ধেক বয়সী জেমিমা বিয়ের কয়েক মাস আগেই ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বলে শোনা যায়। ওই বিয়ের এক মাস পরেই ইংল্যান্ডের রিচমন্ড রেজিস্ট্রি অফিসে ‘সিভিল সেরিমোনি’র মাধ্যমে জাঁকজমকপূর্ণ আবারো তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। বিয়ের পর জেমিমা ইংল্যান্ড ছেড়ে স্বামীর বাড়ি লাহোরে থিতু হন, উর্দু ভাষা শেখেন এবং ঐতিহ্যবাহী পাকিস্তানি পোশাক পরা শুরু করেন। অবশ্য, ২০০৪ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। এর কারণ হিসেবে তখন এক ঘোষণায় বলা হয়েছিল যে, জেমিমা পাকিস্তানে তার স্বামীর রাজনৈতিক জীবিনের সঙ্গে নিজেকে মানাতে পারছিলেন না। ৯ বছরের সংসারে জেমিমা ও ইমরানের সোলাইমান ঈসা খান (২৫) এবং কাসিম খান (২২) নামে দুই পুত্র সন্তান রয়েছে। বিচ্ছেদের পর পুত্রদের নিয়ে জেমিমা ইংল্যান্ডে ফিরে যান। জেমিমার দাবি, ইমরানের সঙ্গে এখনো তার সুসম্পর্ক রয়েছে। জেমিমা সাংবাদিকতা করেছেন। প্রোডিউসার হিসেবেও বেশ নাম করেছেন।

জেমিমার পর ২০১৫ সালে পাকিস্তানের সাংবাদিক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা রেহাম নাইয়ারকে বিয়ে করেন ৬২ বছর বয়সী ইমরান। রেহামকে বিয়ে করার ‘গুজব’ ছড়ালে দেশবিদেশে এ নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। ইংল্যান্ডের হিথ্রো বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের নিজের দ্বিতীয় বিয়ের কথা স্বীকার করে ইমরান খান তখন বলেছিলেন, ‘বিয়ে করাতো কোনো অপরাধ নয়।’ অবশ্য, বছরখানেকও টিকেনি রেহামের সাথে ইমরানের সংসার। বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর দু’জন দু’জনের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অনেক অভিযোগ আনেন। রেহাম ইমরানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন নারীর সঙ্গে সম্পর্কসহ তার সঙ্গে খারাপ আচরণের অভিযোগ তোলেন। অন্যদিকে, রেহামের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে, তিনি ইমরানকে বিষ খাইয়ে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন। কারণ, ইমরানের রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা হাতের মুঠোয় নেওয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য।

ইমরান তার বর্তমান স্ত্রী বুশরা মানেকা ওরফে বুশরা বিবিকে ২০১৮ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে ঘরোয়াভাবে বিয়ে করেন। বুশরা বিবি পিংকি পীর নামে পরিচিত। তিনি আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবেও খ্যাত। যখন তাদের বিয়ের খবর বেরোয়, তখন এর সঙ্গে নানা গুজবও ছড়িয়ে পড়ে। সেগুলোর মধ্যে একটি ছিলÑ বুশরা বিবি স্বপ্নে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.কে) দেখেছিলেন এবং তিনিই তাকে ইমরান খানকে বিয়ে করতে বলেছিলেন যাতে ইমরান এবং পাকিস্তানের ভালো হয়। যদিও পাকিস্তানি সাংবাদিক নাদিম মালিককে দেয়া সাক্ষাৎকার বুশরা ওই গুজবকে সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন বলে দাবি করে বলেন, সুফিজমের সঙ্গে দু’জনের সংযোগই দু’জনকে এক করেছে। তিনি জানান, বিশ্বখ্যাত তারকা হওয়া সত্ত্বেও ইমরান খুব সাদামাটা জীবনযাপন করেন। এমনকি তিনি নিজের পোশাকের দিকেও খেয়াল রাখেন না। ভালো খাওয়া দাওয়ার প্রতিও তার বিশেষ আগ্রহ নেই। ইমরান মুরগির মাংস খেতে পছন্দ করেন। নির্লোভ মানুষ ইমরান শুধু পাকিস্তানের দরিদ্র-অসহায় মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে চান। মুখে ঘোমটাসহ বোরকা পরা নিয়ে বুশরাকে অনেকে উপহাস করলেও এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার ঘোমটা এটা সংজ্ঞায়িত করে না যে আমি আধুনিক নই। কাউকে তার ব্যক্তিত্বের ভিত্তিতে বিচার করা উচিত, মুখের ভিত্তিতে নয়।’ একটা পর্যায়ে বুশরার সঙ্গেও ইমরানের বিবাহবিচ্ছেদের গুঞ্জন ওঠে। কিন্তু ‘বুশরা আমার জন্য আল্লাহর রহমত’ উল্লেখ করে তার সঙ্গে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত থাকতে চান বলে সাফ জানিয়ে দেন ইমরান। অবশ্য, বিয়ের সময়ই ইমরান খান বলেছিলেন, এ বিয়ে তার ‘তৃতীয় এবং শেষ বিয়ে’।

রাজনৈতিক জীবন
খেলোয়াড় হিসেবে অবসরে যাওয়ার আগেই বিভিন্ন দল থেকে রাজনীতিতে যোগ দেয়ার প্রস্তাব পান ইমরান। ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক ইমরান খানকে পাকিস্তান মুসলিম লীগে (পিএমএল) যোগ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফও তাকে নিজ দলে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ইমরান উভয় প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বিশ্বকাপ জয়ের চার বছর পর ১৯৯৬ সালে ইমরান খান নিজের রাজনৈতিক দল তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) প্রতিষ্ঠা করেন। ক্রিকেটের মতো তার রাজনীতির শুরুটাও মসৃণ ছিল না। দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে তাকে তিন বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তেমনি, ১৯৯৭ সালে প্রথমবারের মতো দুটি কেন্দ্র থেকে নির্বাচন করে দুটোতেই হেরে যান তিনি। ২০০২ সালের নির্বাচনের প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ইমরান। ২০০৭ সালের ২রা অক্টোবর সাবেক সেনাশাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফের বিরোধিতা করে ৮৫ জন সংসদ সদস্যের সঙ্গে পদত্যাগ করেন তিনি। ওই নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হয়ে পারভেজ মোশাররফ পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা জারি করেন। ইমরান খান গৃহবন্দী হন। কিছুদিন হাজতবাসের পর মুক্তি পান। যদিও গুজব রয়েছে, ২০০২ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ইমরানকে প্রধানমন্ত্রী বানাতে চেয়েছিলেন। ২০০৮ সালে কারচুপির অভিযোগ তুলে নির্বাচন বয়কট করলেও ২০১৩ সালের নির্বাচনে পিটিআই পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। পরের নির্বাচনেই অর্থাৎ ২০১৮ সালে পিটিআই ১১৮টি আসন জয়লাভ করে। সরকার গঠন করতে প্রয়োজনীয় ১৩৭টি আসন না পাওয়ায় অন্যান্য দল নিয়ে জোট সরকার গঠন করে পিটিআই। নিয়ম অনুযায়ী পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ২০২৩ সালের আগস্টে। কিন্তু তার আগেই নানা নাটকীয়তার পর বিরোধী দলগুলোর আনা অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হওয়া ইমরানের পক্ষে কি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসা সম্ভব হবে- এটাই এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।

কোণঠাসা বাঘ কি ঘুরে দাঁড়াবে?
সব সময় দেশে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন এবং ইসলামি মূল্যবোধের কথা বলে রাজনীতি করা ইমরানের কেন এমন পরিণতি হলো? বলা হয়ে থাকে, পাকিস্তানে কাউকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে তিনটি ‘আ’ অর্থাৎ আমেরিকা, আর্মি এবং আলেম সমাজের সঙ্গে সমঝোতা করে বা ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হয়। বলা হচ্ছে, ইমরানের ক্ষমতায় আসার পেছনে সেনাবাহিনীর আশীর্বাদ থাকলেও নানা কারণে দ্রুতই সেনাবাহিনী তার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এছাড়া সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার সঙ্গে ইমরানের সম্পর্কের অবনতিও এর পেছনে কাজ করেছে। ক্ষমতায় আসা এবং টিকে থাকার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করলেও পাকিস্তানকে ধর্ম সহিষ্ণু রাষ্ট্রে পরিণত করতে ইমরানের কিছু প্রায়োগিক উদ্যোগ দেশটির ‘ইসলামপন্থি’দের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে। তাছাড়া, পাকিস্তান তার জন্মলগ্ন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত হলেও ইমরান খান পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ওই দেশটিকে এড়িয়ে বেশ কিছু বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নেয়া শুরু করেন। প্রথমবারের মতো ইমরান রাশিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ককে নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। চীন এবং রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা বাড়াতে থাকেন তিনি। চীন-রাশিয়ামুখী ইমরানের নানাবিধ পদক্ষেপকে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় তার স্বার্থের জন্য ভয়াবহ হুমকি হিসেবে গণ্য করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্বাচিত হওয়ার পর একবারো ফোন করেননি ইমরানকে। আবার, বাইডেন আয়োজিত বিশ্ব গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেয়েও যোগ দেননি ইমরান।

সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে ইমরানকে রাশিয়া সফর স্থগিত করতে পশ্চিমা দেশগুলো আবেদন করলেও তা গ্রাহ্য করেননি তিনি। ধারণা করা হচ্ছে, সেনাবাহিনীসহ ঘরে-বাইরে ইমরান যখন ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন তখনই বিরোধী দলগুলো ইমরানের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছে। আর তাতেই তারা সাফল্য পেয়েছে। ১৯৯২ বিশ্বকাপে পার্থে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এক ম্যাচে ড্রেসিংরুমে ইমরান নিজ দলের খেলোয়াড়দের উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়াই করো। কারণ, কোণঠাসা বাঘের চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কিছুই নেই।’ রাজনীতির মাঠে ইমরান এখন নিজেই কোণঠাসা। কোণঠাসা বাঘের মতো লড়াই করে ইমরান কি আবারো আল্লামা ইকবালের ‘স্বপ্নে দেখা’ পাকিস্তানের উজিরে আজম হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন?